ভাদু উৎসব ও ভাদু গানের ইতিহাস।
ভাদু উৎসব ও ভাদু গানের ইতিহাস।
শিল্পাঞ্চল ও শহরের বিভিন্ন গ্যারেজ কলকারখানা ছাড়িয়েও গ্রামেও আজ জাঁকজমকভাবে পালিত হচ্ছে বিশ্বকর্মা পুজো। আকাশের ঘুড়ি মাইকে বিভিন্ন গান খাওয়া-দাওয়া দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু রাঢ় বাংলায় বিশেষত পুরুলিয়া, বাঁকুড়া বীরভূম বিভিন্ন গ্রামে ভাদ্র সংক্রান্তিতে পালিত হয় ভাদু উৎসব। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে সামাজিক মাধ্যমে ভাদু উৎসব সেই অর্থে জায়গা করতেই পারেনি। এই ভাদু উৎসব ও ভাদু গানের ইতিহাস লোককথার আকর্ষণীয় গল্পে মোড়া।
লোককথা প্রেক্ষাপটঃ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার পঞ্চকোট রাজ পরিবারের রাজা নীলমণি সিং দেও এর তৃতীয় কন্যা ভদ্রাবতীর বিবাহের দিন বিবাহ করতে আসা পাত্র সহ বরযাত্রীগন ডাকাতদলের দ্বারা খুন হলে ভদ্রাবতী হবু স্বামীর চিতার আগুনে প্রাণ বিসর্জন দেন। এই কাহিনী 1985 খিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিসট্রিক গেজেটিয়ার পুরুলিয়া গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। প্রিয় কন্যাকে স্মরণীয় রাখতে রাজা নীলমণি ভাদু গানের প্রচলন করেন। যদিও রাজার তিন পত্নী ও দশ পুত্রের উল্লেখ থাকলেও কোন কন্যা সন্তানের উল্লেখ নেই রাজ পরিবারের বংশ তালিকায়। রাখালচন্দ্র চক্রবর্তী রচিত পঞ্চকোট ইতিহাস নামক গ্রন্থেও এই ঘটনার উল্লেখ নেই।
বীরভূম জেলায় আবার ভদ্রাবতীকে হেতমপুরের রাজার কন্যা বলা হয়। ভদ্রাবতীর সাথে বর্ধমানের রাজপুত্রের বিবাহ স্থির হয়। বিবাহ করতে আসা রাজপুত্র ও বরযাত্রীগণ ইলামবাজারের নিকটে অবস্থিত চৌপারির শালবনে ডাকাতদের হাতে নিহত হন। বাগদত্ত রাজকুমারের মৃত্যুর সংবাদে ভদ্রাবতী শোকগ্রস্ত ও লগ্নভ্রষ্টা হবার ভয় হবু স্বামীর সাথে সহমরণে যান। রাজকুমারীর এই ভালোবাসা ও আত্মত্যাগকে স্মরণীয় রাখতে রাজা ভাদু গানের প্রচলন করেন। যদিও এই ঘটনার কোন ঐতিহাসিক তথ্য নেই।
ভাদু গানের এবং উৎসবের প্রচলন সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। আর এখানেই প্রশ্ন জাগে ভদ্রাবতী রাজকন্যা এবং রাজা এই দরবারি গান শুরু করলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তা কিভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো? ভদ্রাবতী সম্পর্কে আরেকটি কাহিনী প্রচলিত আছে যা ভাদু গান ও উৎসব সাধারণ মানুষের মধ্যে কেন এত জনপ্রিয় তার যথার্থ উত্তর দেয়। কাহিনীটি হলো-
পুরুলিয়া জেলার কাশীপুর অঞ্চলের একটি গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক ভাদ্রমাসে তার জমির মধ্যে সদ্যজাত এক শিশুকন্যাকে কুড়িয়ে পায়। কৃষক শিশুকন্যাটিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় এবং সন্তান স্নেহে পালন করতে শুরু করেন। সে বছর ভালোবাসা না হওয়ার জন্য চাষ হচ্ছিল না। কিন্তু শিশুকন্যাটি বাড়িতে আনার দুইদিন পরে বৃষ্টি শুরু হয় এবং খুব ভালো চাষাবাদ হয়। কৃৃষক পরিবার বিশ্বাস করতে শুরু করে এই শিশুকন্যাটি লক্ষীর স্বরুপ। রামায়ণে সীতাকে যেমন চাষের জমি থেকে পাওয়া গেছিল সেরকমই এই কন্যাটিও। ভাদ্রমাসে কন্যাটিকে পাওয়ার জন্য নাম দেওয়া হয় ভদ্রাবতী; অনেকের মতে ভদ্রেশ্বরী। সকলে আদর করে ভদ্রাবতীকে 'ভাদু' নামে ডাকতে শুরু করে। ভাদু বড় হবার সাথে সাথে রূপে-গুণে সাক্ষাৎ দেবী লক্ষ্মীর মতো দেখতে হয়। লোকমুখে ভাদুর এই কথা শুনে পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংদেও গ্রামে এসে হাজির হন। ভাদু কে দেখে তিনি মুগ্ধ হন এবং বলেন এই মেয়ে গ্রামের কোন সাধারণ কৃষকের মেয়ে হতে পারে না। তিনি ভাদুকে রাজকন্যা বলেন এবং রাজপ্রাসাদে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু ভাদু তার মা-বাবাকে ছেড়ে যেতে রাজি না হলে রাজা ঘোষণা করেন ভদ্রাবতী যেখানেই থাকুক সে রাজকন্যা। সখীদের সাথে খেলা করে ঘুরে আনন্দেই জীবন কাটছিল ভাদুর। জীবনের অনেকগুলি শরৎকাল অতিক্রম করে ভাদু যৌবনে পদার্পণ করেন। পাশের গ্রামের এক সুদর্শন যুবক অঞ্জনের সাথে ভাদুর পরিচয় হয় ধীরে ধীরে মন দেওয়া নেওয়ার সম্পর্কে পরিণত হয়। ভদ্রাবতী গান গাইতো আর অঞ্জন সেই গানের সুরে বাঁশি বাজাত।
এই সম্পর্কের কথা রাজা জানতে পারলে রেগে ওঠেন। তিনি চেয়ে ছিলেন তাঁর কন্যাকে উচ্চ রাজবংশে বিবাহ দিতে। অঞ্জনের মত সমাজের সাধারন ছেলের হাতে তার কন্যাকে তুলে দিতে রাজি হননি। রাজার আদেশে অঞ্জনকে আটক করে কোন গুপ্ত স্থানে রাখা হয়। প্রাণের থেকেও প্রিয় অঞ্জনকে দেখতে না পেয়ে ভাদু ঘুরে ঘুরে বেড়াতো আর গান গাইতো। যদি তার কণ্ঠ শুনতে পেয়ে অঞ্জন ফিরে আসে। দীর্ঘদিন ধরে দিবারাত্রি ভাদু গান করতে করতে দুঃখে কষ্টে অঞ্জনকে খুঁজতে থাকে। রাজা নীলমণি কন্যার এরূপ দুরবস্থা দেখে প্রায় এক প্রকার বাধ্য হয়ে অঞ্জন কে মুক্তি দেন। মুক্ত অঞ্জন তার ভাদুর কাছে গেলে ভাদুকে আর দেখতে পায়নি। অনেক খোঁজাখুঁজি করা হলেও ভাদুর আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। গ্রামের অনেকে বলেন ভাদু আকাশ থেকে এসেছিল আকাশেই ফিরে গেছে। আবার অনেকের মতে ভাদু জমির মধ্যেই ফিরে গেছে; কেউ কেউ আবার বলেন কান্না নদী হয়ে ভাদুকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এই ঘটনায় রাজা নীলমণি অত্যন্ত কষ্ট পান এবং ভদ্রাবতীকে স্মরণীয় রাখতেই ভাদু গানের সূচনা করেন। যদিও এই কাহিনীর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। কিন্তু ভাদু গানের ইতিহাস জানতে গিয়ে এই কাহিনীকেই সত্যি বলে মন মানতে চায় ইতিহাসের তথ্য বিশ্লেষণ সব ভুলে যেতে চাই।
ভাদু পূজার রীতিঃ পয়লা ভাদ্র কুমারী মেয়েরা বাড়ির কোন কুলুঙ্গি বা ছোট প্রকোষ্ঠ পরিষ্কার করে ভাদু প্রতিষ্ঠা করে আরাধনা শুরু করে। একটি পাত্রে ফুল বা গোবরের উপর ধান ছড়িয়ে রেখে ভাদুর বিমুর্ত রূপকল্পনা করে সমবেত কণ্ঠে ভাদু গান গাওয়া হয়। ভাদ্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে ভাদু মূর্তি বাড়িতে আনা হয়। পূর্বে ভাদু মূর্তি ছিল না। বর্তমানে হংস, ময়ূর বা পদ্মের উপর ভাদু মূর্তি গড়ে ওঠে; অভিজাত পরিবারের কুলদেবী লক্ষীর মতো রূপে। যা দেখে মনে হয় মা লক্ষী কুলীন ধনী পরিবারগুলোর সিংহাসন বন্দী না থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যেই বিরাজ করছে ভাদু নামে। ভাদকে ভাদ্রমাসের লক্ষ্মী হিসাবেও অনেকেই পুজো করে।
ভাদ্র সংক্রান্তির আগের রাতে ভাদু জাগরণ পালন করা হয়। রঙিন কাগজ বা কাপড়ের তৈরি ঘরে ভাদু মূর্তি স্থাপন করা হয় এবং বিভিন্ন মিষ্টি সাজিয়ে দেওয়া হয় ভোগ হিসাবে। বিশেষত বৃহৎ আকারের জিলিপি এবং গজা। জিলিপির আকার ছোট হলে মা ভাদু অভিমান করেন বলে সবাই মনে করে। ভাদু উপাসকরা রাত্রি ৯ টা বা ১০ টা বাজলে ভাদু গান গাইতে শুরু করে। ভাদ্র সংক্রান্তির দিন সকাল থেকে বিকেলের মধ্যে ভাদু মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হয় এবং অপেক্ষা করা হয় পরের বছরের।
বীরভূমে ভাদু পূজার রেওয়াজটা একটু অন্যরকম। মূলত গ্রামের কয়েকজন মিলে একটি ভাদু মূর্তি এবং একটি ছোট ছেলেকে ভাদু সাজিয়ে গান করে করে পাড়া ঘোরে। সকলে এই দলকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় এবং কিছু পয়সাও দেয়।
ভাদু গানঃ ভাদু উৎসব মূলত ভাদু গানের ধারায় পালন করা হয়। আর এই গান সীমিত নয় সমাজের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর এই গান তৈরি হয়। পূজার সূচনালগ্নে যে গান গাওয়া হয়-
কাশীপুরের রাজার বিটি/
বাগদি ঘরে কী কর?/
কলসী কাঁধে লয়ে পরে,/
সুখ সাগরে মাছ ধর।
ভাদু মূর্তি পুজোর জন্য যে জিলিপি ভোগ দেওয়া হয় তা নিয়ে একটি গান সেটি হল-
অবাক দেখে শুনে/
কেজ্ঞাকুড়ার অশোক দত্তের দোকানে/
বড় বড় জিলিপি গুলা সওয়া কেজি ওজনের/
আবার খাজা গুলা একফুট করে/
দেখে এলাম নয়নে।
ভাদু মূর্তি বিসর্জন এর পূর্বে বরণের সময় গাওয়া হয়-
তিরিশ দিন রাইখলাম ভাদু তিরিশটি ফুল দিয়ে/
আর তো রাইখতে লাইরবঅ ভাদু চাতা হইলঅ বাদী গো।
বিসর্জনের সময় সবাই সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে-
যাছঅ যদি ভাদুমনি কাঁদঅ টেনে অকারণ/
আর বছরে থাকি যদি আইনব গো প্রাণধন।
ভাদু গানের মাধ্যমে একসময় বর্গাদারী নিয়মের ও প্রচার করেছিল-
চল ভাদু চল জেলার অফিসে/
বর্গাদার আইন উঠ্যাছে/
বর্গা রেকর্ড করাতে।
আবার বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপন হিসেবেও ভাদু গান ব্যবহার করা হয়-
সিম এসেছে জিও/
এবার কিন্তু যাবার আগেই আমায় একটা দিও/
গতবছর স্পিড ছিল না/
2G-3G র জন্য/
4G যখন এসে গিয়েছে/
এবার ব্যাপার অন্য।
আবার সরকারি প্রকল্প নিয়ম ভাদু গান গাওয়া হয়-
দশম শ্রেণী পড়তেই হবে/
উচ্চমাধ্যমিকও পাশ হওয়া চাই/
২৫ হাজার টাকা পাবে/
১৮ বছর হওয়া চাই/
অষ্টম শ্রেণী পড়ে গো যারা/
বাই সাইকেল পাবে গো তারা/
সাথে আছি সবুজ সাথী/
এখন ইস্কুলেতে সবাই যাবে/
করবে লেখাপড়া।
ভাদু উৎসব কোন আচার ও ধর্মীয় জটিলতায় আবদ্ধ নয়। এটি মূলত আনন্দ উদযাপন উৎসব। পুরোহিত, উপবাস, মন্ত্র এই উৎসবে দেখা যায় না। পূর্বে প্রচলিত গান এবং সমাজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নতুন করে লেখা গান সমবেত কণ্ঠে গান করে এই উৎসব পালন করা হয়। ভাদু কে সব পরিবার নিজের কন্যা মনে করে তাইতো সবাই গান করে-
ভাদু আমার ছোট মেয়ে/
কাপড় পরতে সে জানেনা।
তথ্যসূত্রঃ সীমান্ত রাঢ়ের লোকসংস্কৃতি- দিলিপ কুমার গোস্বামী।
উইকিপিডিয়া।
Posted by- Abhisek Dutta
Thanks to Anushka Dutta
© ABHISEK DUTTA
Thanks for Visiting My Blog.
জানার জিনিস ! পড়ে ভালো লাগলো
ReplyDelete