প্রাচীন ভারতবর্ষের বিবাহ পদ্ধতি ( Marriage System of Ancient India)

প্রাচীন ভারতবর্ষের বিবাহ পদ্ধতি ( Marriage System of Ancient India)

 

বিবাহ বা বিয়ের বর্তমানের পদ্ধতি বললে বাঙালি সমাজের প্রথম মনে আসে-

যদিদং হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম।

যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব।

এর অর্থ হলোঃ

যেখানে হৃদয় তোমার, সেখানে হৃদয় আমার। 

যেখানে হৃদয় আমার, সেখানে হৃদয় তোমার।

এই মন্ত্র উচ্চারণ এর মধ্যে দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একে অপরের প্রতি সমভাব, আপন করে নেওয়া, একে অপরের দায় দায়িত্ব গ্রহণ করা এবং জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধনে আবদ্ধতা স্বীকার করে নেওয়া। 

যদিও বিবাহ প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবীর সকল জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান। কিন্ত এই একই প্রকার বিবাহ রীতি সব সমাজে নেই। ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশগত পার্থক্যের জন্য বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহ পদ্ধতিও আলাদা হয়। 

বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে  বিভিন্ন প্রকারের বিবাহ পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। ধর্মসূত্র, কৌটিল্যের লেখা অর্থশাস্ত্র মনুস্মৃতিতে আট রকম বিবাহের উল্লেখ আছে। এগুলি হল-

1) ব্রাহ্ম বিবাহঃ পিতা বা অভিভাবক কন্যাকে বিশেষ বস্ত্র অলংকার দিয়ে সাজিয়ে বিদ্বান চরিত্রবান পাত্রের হাতে সমর্পণ করতেন, সেটিকে বলা হতো ব্রাহ্ম বিবাহ।

 

) দৈব বিবাহঃ যজ্ঞ সম্পাদনকালে ঋত্বিককে সালংকরা কন্যা দানকে দৈব বিবাহ বলে। বর্তমানে ভারতবর্ষে এই বিবাহ পদ্ধতি নেই বললেই চলে।

 

) আর্য বিবাহঃ এই বিবাহে পাত্রের নিকট হইতে কন্যার পিতা একটি গরু একটি বলদ অথবা দুই জোড়া বলদ গ্রহণ করে যজ্ঞ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কন্যা সম্প্রদান পদ্ধতিই আর্য বিবাহ নামে পরিচিত।

 

) প্রাজাপত্য বিবাহঃ 'তোমরা উভয়ে সুখে গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করো' এই আশীর্বাদ করে পিতা বা অভিভাবক বরের হাতে কন্যাকে সমর্পণ করে, তাকে প্রাজাপত্য বিবাহ বলে।  বর্তমানে বাঙালি সমাজে এই বিবাহ প্রচলিত। 

 

) অসুর বা আসুর বিবাহঃ যদি কোন ব্যক্তি কোন কন্যার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কন্যার পিতামাতা বা  আত্মীয়কে অর্থ প্রদান করে বা অন্য কোন উপায়ে  বিবাহ করা কে  অসুর বা আসুর বিবাহ বলে।

 

) গান্ধর্ব বিবাহঃ অভিভাবকের অজ্ঞাতসারে পাত্র-পাত্রী যখন পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পাণিগ্রহণ করে, সেই বিবাহ প্রথাকে গান্ধর্ব বিবাহ বলে।

 

) রাক্ষস বিবাহঃ কন্যার পরিবারের লোকজনদের নিহত  বা আহত করে কন্যাকে জোরপূর্বক হরণ করে বিবাহ করার পদ্ধতিকে রাক্ষস বিবাহ বলে। প্রাচীনকালে অনেক রাজা বলপূর্বক অনেক নারীকে হরণ করে বিবাহ করত।  বর্তমানে এই বিবাহ পদ্ধতি নেই।

 

) পৈশাচ বিবাহঃ নিদ্রিত অচৈতন্য বা বিকৃত মস্তিষ্ক নারীকে জোরপূর্বক নিয়ে গিয়ে নির্জন বিবাহ করার রীতি কে পৈশাচ বিবাহ বলে। এই ধরনের বিবাহ সমাজে নিন্দনীয় ছিল।

 

বৌদ্ধ জৈন সাহিত্যে দৈব, আর্য পৈশাচ বিবাহ উল্লেখ নেই। দায়ভাগ গ্রন্থে জীমূতবাহন- ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য এবং গান্ধর্ব বিবাহ অনিন্দনীয় বলে উল্লেখ করেছেন। গুপ্ত যুগে চার ধরনের বিবাহের প্রচলন ছিল ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য প্রাজাপত্য বিবাহ। যদিও রাজকন্যাদের জন্য স্বয়ংম্বর সভা রাজপরিবারের পাত্র-পাত্রীদের মধ্যে গান্ধর্ব বিবাহের প্রমাণ পাওয়া যায়। রাষ্ট্রকূট রাজবংশের নারীরা স্বয়ংবর সভার মাধ্যমে প্রতি নির্বাচন করতে পারত। অনুলোম বিবাহ (উচ্চবর্ণের পুরুষের সাথে নীচু বর্ণের মেয়ের বিবাহ‌) এবং প্রতিলোম বিবাহ (নীচু বর্ণের পুরুষের সঙ্গে উচ্চবর্ণ মেয়ের বিবাহ) পরবর্তী বৈদিক যুগে একজন আর্য পুরুষ শূদ্র মহিলাকে বিবাহ করতে পারতেন। কিন্তু কোন আর্য নারীকে বিবাহ করার অধিকার শূদ্র পুরুষের ছিল না। অসবর্ণ বিবাহ পরবর্তী সন্তান পিতার বর্ণে পরিচিত হত। রাজ পরিবার বা অভিজাত শাসক পরিবারের পুরুষদের মধ্যে বহুবিবাহের প্রচলন ছিল। নারী পুনরায় বিবাহ করতে পারতো বলে পরাশর সংহিতায় উল্লেখ আছে-

"নষ্টে, মৃতে, প্রব্রজিতে, ক্লীবে পতীতে পতৌ। পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরান্যো বিধিয়তে"

অর্থাৎ স্বামী নিরুদ্দেশ হলে, মারা গেলে, সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করলে, ক্লীব হলে অথবা পতিত হলে নারীরা অন্য পতি বরণ করতে পারে। 

বিবাহ সাধারণত হতো একই জাতির মধ্যে কিন্তু ভিন্ন গোত্রে।  হিউয়েন সাঙ এর বর্ণনাতেও এক‌ই কথা উল্লেখ আছে। বৌধায়ন- ধর্মসূত্রে পিসতুতো মামাতো ভাই বোনের বিবাহের উল্লেখ আছে। শাক্যদের মধ্যেও ভাই বোনের বিবাহ চালু ছিল। বৈশালীর লিচ্ছবিরাও তাদের গোষ্ঠীর ভিতরেই বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করত। গুপ্ত পরবর্তী যুগে মেয়েদের 12 বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিবাহ দেয়া হতো। হরিভদ্র ধর্মবিন্দু গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে বিবাহের বয়স ছেলেদের 26 এবং মেয়েদের 12 বছর হওয়া উচিত। সেন যুগে বিবাহে যৌতুকপ্রথা কৌলিন্য প্রথার  প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছিল। চর্যাপদে বিবাহের সময় বরপক্ষকে যৌতুক গ্রহণ করতে দেখা যায়। সুতরাং যৌতুক প্রথা যে প্রাচীন ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। 

প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে যেসকল বিবাহ পদ্ধতি প্রচলিত ছিল তার বেশির ভাগই আজ নেই বললেই চলে। যেগুলো রীতিনীতি প্রচলিত আছে সেগুলি যুগের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রয়োজনে সুবিধার্থে  বিবর্তিত রূপে বিরাজমান। বর্তমানে যৌতুকপ্রথা বিবাহের অন্যতম অঙ্গ হিসাবে আছে। যা বেশিরভাগ সময়ই কন্যার পরিবারের নিকট যন্ত্রণার কারণ হয় দেখা দেয়। ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিবাহ হলো জন্ম জন্মান্তরে বন্ধন। যদিও বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক হারে বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে বিবাহের গুরুত্ব একটু হলেও দুর্বল হয়েছে। ভারতবর্ষে প্রতিটি সমাজে বিবাহ নিজের ঐতিহ্যের সাথে  গুরুত্বসহকারে হয়ে চলেছে। এর অন্যতম কারণ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে ভারতীয় বিবাহ পদ্ধতি নিজেকে যুগের উপযোগী করে নিত্য নতুন সাজে গুছিয়ে নিয়েছে।

 

তথ্যসূত্রঃ

) ভারত-ইতিহাসের সন্ধানে- দিলীপ কুমার গঙ্গোপাধ্যায়।

) উইকিপিডিয়া।

) Ancient India- R.C Majumdar.

 

 

https://www.youtube.com/channel/UCj8KZK_eysK_zYaHhQzFhbQ

@ ABHISEK DUTTA

Posted & Written by- Abhisek Dutta

                                     Assistant Teacher

   Thank You for Visiting my Blog

 

                                                                


Comments

Popular posts from this blog

নবম শ্রেণির ইতিহাস প্রথম অধ্যায়- ফরাসি বিপ্লবের কয়েকটি দিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর।

অষ্টম শ্রেণির পরিবেশ ও বিজ্ঞান বিষয় তাপের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর

প্রাকৃতিক ঘটনা ও তার বিশ্লেষণ। অধ্যায়-পঞ্চম * শ্রেণি-অষ্টম * বিষয় পরিবেশ ও বিজ্ঞান।