ভারতবর্ষের হারিয়ে যাওয়া রহস্যময়ী একটি নদী-'সরস্বতী' (The Lost River Saraswati)


ভারতবর্ষের হারিয়ে যাওয়া রহস্যময়ী একটি নদী-'সরস্বতী'


                                               বিগত কয়েক বছর ধরে প্রাচীন ভারতের একটি নদী যার নাম 'সরস্বতী' তা বহু চর্চিত। এই চর্চার একটি অন্যতম কারণ হলো এই নদীটি একসময় ভারতবর্ষের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদী হিসাবে বাহিত হতো, যা বর্তমান গবেষণায় প্রমাণিত। এই নদীটির অস্তিত্ব ছিল হরপ্পা সভ্যতা বৈদিক সভ্যতা যুগে। ঋকবেদে এই নদী সম্পর্কে অনেক শ্লোক আছে। শ্লোকগুলিতে নদীটির প্রশংসাও বর্তমান। এই নদীকে যমুনা শতদ্রু নদীর মধ্যবর্তী স্থানে প্রবাহিত পবিত্র বলে পরিগণিত করা হত। 

"মে গঙ্গে যমুনে সরস্বতী শুতুদ্রী সতেমম্ সততা পরুষ্ণ্যয়া অসিকন্যা মরুদধ্রমে বিতস্তযার্জীকীয়ে শর্নুহযাসুপোমহ।

তষ্টার্ময়া পরথম মাতবে সজুঃ সসর্ত্বা রসয়াশ্বত্যা তয়া তবম্ সিন্ধো কুভয়া গোমতী করুমুম্মোহত্ত্বা সরধম যাভিরীয়সে।" (ঋগ্বেদ দশম মন্ডল সূক্ত-৭৫.৫-৬)

এই সুক্ততে বর্ণিত সরস্বতী নদী যমুনা ও শতদ্রু নদীর মধ্যবর্তী অবস্থিত।


মানচিত্র-০১

এই নদীকে 'দেবীত‌্বম', 'নদীত্বম', 'সিন্ধুমাতা' বলে বর্ণনা করা হয়েছে ঋকবেদে। শুধু ঋকবেদে নয় পুরান, মহাভারত এ এই নদীর উল্লেখ আছে। সরস্বতী দৃষদ্বতীর মধ্যবর্তী স্থানকে দেবনির্মিত বলে মনে করা হত। ব্রাহ্মণ মহাভারতে উল্লেখিত স্বারস্বত যজ্ঞ এই নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়। এই নদীর পাশে বসে ঋগ্বেদ রচনা করা হয়, একে বাগদেবী (ঋকবেদে উল্লেখিত, অম্বিতমে,নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী) হিসেবে মনে করা হয়।

"অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী অপ্রশস্তা ইব সমসি পরশস্তিমম্ব নস কার্থি।" (ঋকবেদ দ্বিতীয় মন্ডল ৪১.১৬ সূক্ত)

অর্থাৎ তুমি মায়েদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, নদীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, দেবীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, হে মা সরস্বতী। তোমার দেওয়া জ্ঞান ব্যতীত জীবন ব্যর্থ। আমাদের দিশা প্রদান করো।

দেবীরুপে সরস্বতী

যদিও কোনো অজানা কারণে এই নদী হারিয়ে যায় পৃথিবীর বুক থেকে। বেশ কয়েক বছর আগে BBC News (British Broadcasting Corporation) একটি অনুষ্ঠান করা হয় এই নদীর উপরে যার নামকরণ করা হয়- "India's Miracle River" বাংলায় যাকে বলা হয়- "ভারতের রহস্যময় নদী" নদীর স্রোতস্বিনী তা ধর্মই হলো স্বাভাবিক। কিন্তু এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীর অন্তর্ধান‌ই হল সবচাইতে বড় প্রশ্ন। আর রহস্য দানা বেঁধেছে এখানেই।


 সংস্কৃতে 'সরস'' শব্দের অর্থ পুকুর বা জলাশয় এবং বতী শব্দের অর্থ যা জলকে ধারণ করে থাকে। ব্রাহ্মণ গ্রন্থ থেকে জানা যায় সরস্বতী নদী হিমালয় পর্বতের পাদদেশে প্লাক্ষ্সপ্রস্রবণ থেকে উৎপত্তি হয়ে (এই নামটি আবার 'প্লাক্ষ্স' নামে একটি রাক্ষসের নামকরণে করা হয়) পশ্চিমে হরিয়ানা পাঞ্জাবের আম্বালা জেলা অতিক্রম করে উত্তর-পশ্চিম রাজস্থানে চোলিস্থানের বালুকা ভূমিতে (সরস্বতী নদী রাজস্থানের চলুর গ্রামের নিকটে অদৃশ্য হয়ে ভবানীপুরের দৃশ্য হয়। 

"একাচেতত সরস্বতী নদীনাম্ শুচির্যতি গিরিভ্য আ সমুদ্রাত "। ( ঋগ্বেদ সপ্তম মন্ডল ৯৫.২ সূক্ত)

এর অর্থ সরস্বতী একমাত্র নদী যার জলরাশি হিমালয় থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত।

আবার বলিচ্ছপুর নামকস্থানে অদৃশ্য হয়ে বরখের নামকস্থানে দৃশ্য হয়) আত্মগোপন করে। এই নদীটি যেখানে এসে হারিয়ে যায় তাকে আমরা মরুস্থলি বলে জানি। যার অর্থ "Land of the Dead". মহাভারতে আছে যে নিষাদদের চোখের আড়ালে থাকার জন্য বিনাশন নামক স্থানে মরুভূমিতে সরস্বতী নদী অদৃশ্য হয়েছে

"দর্ষদ্ বত্যাম্ মানুষ আপয়ায়াম্ সরস্বত্যাম্ রেবদগ্নেদিদীহি" ( ঋগ্বেদ তৃতীয় মন্ডল সূক্ত-২৩.৪)

এর অর্থ দৃষদেবতী নদী ও অপয়া নদী দুটিকে সরস্বতীর‌ই উপনদী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।

আনুমানিক মহাভারত লেখার পূর্বেই এই নদী অদৃশ্য হলেও চমসোদ্ভেদ, শিবোদ্ভেদ নাগোদ্ভেদ অবশিষ্ট রূপে বহমান ছিল। কিছু বৈদিক গ্রন্থ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে বলা হয়েছে 'বিনাশন' নামক নামে একটি জায়গাতে নদীটি হারিয়ে যায়। সংস্কৃতে 'বিনাশন' এর অর্থ হয়ে যাওয়া।

 

মানচিত্র-০২

                                               নদীটির এই অদৃশ্য-হওয়া কে কেন্দ্র করে মহাভারত, পুরান প্রভৃতিতে অনেক কিংবদন্তির অবতারণা করা হয়। এর মধ্যে কিছু কিছু ভিত্তিহীন বলেও মনে করা হয়। তবে পদ্মপুরাণ এর একটি উপকথায় বলা হয়অনিচ্ছুক সরস্বতী তাঁর পিতার নির্দেশে বাধ্য হয়ে সারা পৃথিবী ধ্বংসকারী অগ্নি কে সমুদ্রে পতিত করে। পুষ্কর এর কাছে একটি বাঁধার সৃষ্টি হলে শেষ পর্যন্ত সফল হয়। এখানে পৃথিবী ধ্বংসকারী অগ্নিকে খরা বা ব্যাপক উষ্ণতার প্রভাব ধরা যেতেই পারে।

খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষ


 

       সরস্বতী অভিযানে নেমে প্রত্নতত্ত্ববিদ অরেল স্টাইন স্থানীয় অনেক বিশ্বাসের কথা জানতে পারেন। ঘাগ্গর বা হাকরা  নদীর সবচেয়ে পূর্বের শাখানদীটি কে স্থানীয় লোকেরা বলে সরসুতি। এই নদী বয়ে যায় কুরুক্ষেত্র আর থানেশ্বরের তীর্থভূমি উপর দিয়ে। এই নদীর দুই পাড়ে এখন কিছু সাধারন গ্রাম‌ই বর্তমান। কিন্তু অস্বাভাবিক বেশি সংখ্যায় ঢিপির উপস্থিতি দেখে মনে হয় মাটির নিচে হয়তো এক অতীত লুকিয়ে আছে। স্থানীয় লোকেরা ওই শুকনো নদীর বুকের ওপর দিয়ে ফেরি পারাপারের গল্প বলেন।

 

মানচিত্র-০৩

ভূবিজ্ঞানী প্রত্নতত্ত্ববিদরা বেশ কিছু  কারণ নির্দেশ করেছেন এই নদী শুকিয়ে যাওয়ার জন্য। যেমন- মরুভূমির উপর দিয়ে এত দীর্ঘ যাত্রা, অতিরিক্ত ভূমিকম্প প্রবণতা যার ফলে যমুনার দিক পরিবর্তন।  যার একটি ধারার দ্বারা সরস্বতী নদী পুষ্ট হত। আবহাওয়ার পরিবর্তন, এমনকি মনে করা হয় যে পরিণত হরপ্পা সভ্যতা একটি খরা সময়ে প্রতিভাত হয়। যার দরুন এই নদীর উপর চাপ পড়ে।

 

হরিয়ানায় খননকার্যের কিছু চিত্র



                                             বর্তমানে এই নদীর রহস্য উদঘাটনের জন্যই হোক বা প্রয়োজনের খাতিরেই হোক গবেষণার পাশাপাশি খননকার্য শুরু করেছে। ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন সভ্যতার সাক্ষী গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র সরস্বতী নদীর হারিয়ে যাওয়া রহস্য জানতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবেযতদিন না প্রত্নতত্ত্ববিদদের গবেষণা সম্পূর্ণ হয়।


তথ্যসূত্রঃ 

1) Michel Danino- The Lost River: On the Trail of the SARASWATI.

                           2) Wikipedia.

                           3) Google.

Posted & Written by - Abhisek Dutta (Assit Teacher)

© ABHISEK DUTTA

Thank You for Visiting my Blog


                                                       

 

                                                  

 


Comments

  1. Beautiful 😍 mythological and scientific Explanation Sir, thanks for it.

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

মানুষের খাদ্য ও খাদ্য উৎপাদন অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর। বিষয়- পরিবেশ ও বিজ্ঞান * শ্রেণি অষ্টম।

অষ্টম শ্রেণি পরিবেশ ও বিজ্ঞানঃ জীবদেহের গঠন- ষষ্ঠ অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর।

অণুজীবের জগৎ অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর, পরিবেশ ও বিজ্ঞান *শ্রেণি-অষ্টম।